
স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের ঘোষিত ১২দিনের কর্মসূচি শেষ হলেও খুলনার সব পাটকলে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। অব্যাহত রয়েছে ৭ম দিনের মতো কর্মবিরতি। সাপ্তাহিক মজুরী না পেয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন খুলনা-যশোর অঞ্চলের নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলের ২৬ হাজারের অধিক শ্রমিক। অর্ধাহার, অনাহার, এমনকি রোগে শোকে ডাক্তার দেখাতে পারছেন না তাঁরা। দোকানীরাও আর বাকিতে পণ্য দিচ্ছেননা। সন্তানকে নতুন ক্লাসে ভর্তি বা স্কুল পোষাক কিনতে পারছেননা অনেকেই। গরম পোশাকের অভাবে কেউ কেউ শীতে কষ্ঠ পাচ্ছেন। তবে কবে নাগাত মিলবে সমাধান এমন সঠিক উত্তর নেই বাংলাদেশ জুটমিল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) কাছে। এ অবস্থায় শ্রমিকদের সাফ জবাব, সব বকেয়া পরিশোধ না হলে মিলের চাকা ঘুরবেনা।
বাংলাদেশে ২২টি রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলের মধ্যে খুলনায় সাতটি ও যশোরে দুইটি পাটকল রয়েছে। বিজেএমসি’র নভেম্বর ২০১৭ এর হিসেব অনুযায়ী এই নয়টি পাটকলে শ্রমিক রয়েছে ২৬ হাজার ৭১৮ জন। এরমধ্যে স্থায়ী শ্রমিক ১২ হাজার ২১৩ এবং বদলী বা দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক ১১ হাজার ৬৩৪ জন। খুলনাঞ্চলের সাতটি পাটকলের মধ্যে আটরা শিল্পাঞ্চল এলাকার আলীম জুট মিলস্ লিমিটেডে মোট শ্রমিক এক হাজার ৩৮৫; যার স্থায়ী ৭৮৫ ও বদলী ছয়শ’, খালিশপুরের ক্রিসেন্ট জুট মিল্স কোম্পানী লিমিটেডে শ্রমিক সাত হাজার ৪০৭; যার স্থায়ী তিন হাজার ৪১৭ ও বদলী তিন হাজার ৯৯০; খালিশপুরে অবস্থিত দৌলতপুর জুট মিলস্ লিমিটেডে শ্রমিক ৪৭৩ জন; যাদের সকলে দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক, আটরা এলাকার ইস্টার্ণ জুট মিলস্ লিমিটেডের শ্রমিক দুই হাজার ১৬৭ জন; এর স্থায়ী এক হাজার ও বদলী এক হাজার ১৬৭, খালিশপুরে অবস্থিত খালিশপুর জুট মিলস্ লিমিটেডে শ্রমিক আছে দুই হাজার ৩৯৮; যাদের সকলেই দৈনিক ভিত্তিক, খালিশপুরের প্লাটিনাম জুট মিলস্ লিমিটেডের শ্রমিক হল পাঁচ হাজার ৭২৯ জন; যাদের স্থায়ী তিন হাজার ২২৩ ও বদলী দুই হাজার ৫০৬ এবং দিঘলিয়ার স্টার জুট মিলস্ লিমিটেডে শ্রমিক আছে তিন হাজার ৮৩৪ জন; এদের স্থায়ী দুই হাজার ১৪৪ ও বদলী এক হাজার ৬৯০ জন।
অপর দিকে যশোর অঞ্চলে রয়েছে দুইটি রাষ্ট্রায়ত পাটকল। এর একটি নওয়াপাড়া এলাকার কার্পেটিং জুট মিলস্ লিমিটেড। যেখানে মোট শ্রমিক রয়েছে ৮৫২ জন; এরমধ্যে স্থায়ী ৪০৪ ও বদলী শ্রমিক ৪৪৮ জন। অপরটি একই এলাকায় অবস্থিত জেজেআই এর মোট শ্রমিক সংখ্যা দুই হাজার ৪৭৩ জন; এর স্থায়ী এক হাজার ২৪০ ও বদলী এক হাজার ২৩৩ জন।
এ সব শ্রমিক- যাদের সাপ্তাহিক মজুরী দুই হাজার থেকে দুই হাজার পাঁচশ’ টাকা মাত্র, কিন্তু মিল ভেদে এসকল কর্মী পাঁচ থেকে ১২ সপ্তাহ ধরে মজুরী পাননা। যার পরিমান ৪০ কোটি ৬৮ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এরমধ্যে ক্রিসেন্টে নয় সপ্তাহের বাকি ১৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, প্লাটিনামে আট সপ্তাহের বাকি আট কোটি, জেজেআই এর ১২ সপ্তাহের বাকি ছয় কোটি ৮৪ লক্ষ, স্টারে পাঁচ সপ্তাহের বাকি তিন কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। এছাড়া খালিশপুর জুট মিলে পাঁচ সপ্তাহের বাকি দুই কোটি ৮০ লক্ষ, ইস্টার্ণে ছয় সপ্তাহের বাকি দুই কোটি ২২ লাখ, কার্পেটিং এ ১০ সপ্তাহের বাকি এক কোটি ৮০ লক্ষ, আলীমে আট সপ্তাহের বাকি এক কোটি ৬৮ লাখ এবং দৌলতপুর জুট মিলের চার সপ্তাহের বাকি রয়েছে ৩৯ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা।
এ নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের কার্যকারি আহবায়ক সোহরাব হোসেন বলেন, মজুরী না পেয়ে শ্রমিকরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছেন। দীর্ঘ দিন পাওনা টাকা না পাওয়ায় অর্ধাহারে অনাহারে রয়েছেন তাঁরা। এমনকি নতুন ক্লাসে ভর্তি করাতে পারছেন না ছেলেমেয়েদের, পারছেনা স্কুলের নতুন পোষাক কিনে দিতে। অসুস্থ হলে কিনতে পারছেন না ওষুধ, দেখাতে পারছেন না ডাক্তার। অনেকে আবার শীতে অর্থের অভাবে কিনতে পারছেন না গরম পোষাক।
পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহবায়ক মোঃ খলিলুর রহমান জানান, খালিশপুর অঞ্চলের অনেক দোকান শ্রমিকদের বাকি দিতে দিতে বন্ধ হয়ে গেছে। আর যেগুলো কোন রকম চলছে তারা এখন শ্রমিকদের বাকি দিতে চাননা। তাই শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধসহ ১১ দফা দাবি ও সুপারিশে বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের ব্যানারে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচীর পাশাপাশি গতকাল পর্যন্ত একটানা আট দিন মিলের সকল প্রকার উৎপাদন বন্ধ রেখেছি এবং যতদিন আমাদের পাওনা পরিশোধ না করবে ততদিন মিলের চাঁকা ঘুরবেনা।
বিজেএমসি’র খুলনা অঞ্চলের লিঁয়াজো কর্মকর্তা ও মহাব্যবস্থাপক গাজী শাহাদাৎ হোসেন জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ও স্থানীয় বাজারে ইতোমধ্যে পাটজাত পণ্য বিক্রি করা হয়েছে, বিক্রির সেই টাকা পাওয়া গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শ্রমিকদের সাপ্তাহিক মজুরী পরিশোধ করা হবে।
এদিকে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব আট পাটকলে শ্রমিক অসন্তোষে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকরা পাটকলগুলোর উৎপাদন বন্ধ রাখায় নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে খালিশপুর শিল্পাঞ্চল। গত ২৮ ডিসেম্বর শুরু হওয়া কর্মবিরতি অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) কর্মবিরতির সপ্তমদিনে খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে সড়ক অবরোধ, টায়ারে আগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভ করেছে শ্রমিকরা। এদিন ক্রিসেন্ট, স্টার, ইস্টার্ণ, খালিশপুর ও দৌলতপুর জুট মিলে শ্রমিকদের এক সপ্তাহের মজুরি প্রদান করা হলেও হয়নি প্লাটিনাম, আলীম ও জেজে আই জুট মিলে। ফলে প্লাটিনাম জুট মিল শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছে। খুলেছে নোঙ্গরখানা। দুপুরে সেখানেই শ্রমিকরা খেয়েছে। এছাড়া সিবিএ নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করেছে।
এদিকে, গত ৬ দিনে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকার পাটজাত পণ্য উৎপাদন বিঘিœত হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটানো শ্রমিকরা বলছেন, বকেয়া সব মজুরি এক সাথে না পাওয়া পর্যন্ত তারা কাজে ফিরে যাবেন না।
সূত্রটি জানায়, ৮টি পাটকলের ২৬ হাজার ৭১৮ জন শ্রমিকের ৪ থেকে ১২ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া রয়েছে। সবমিলিয়ে শ্রমিকদের পাওনার পরিমাণ ৪০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ৯টি পাটকলে বর্তমানে ২১ হাজার ৪৭৪ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য বিক্রির অপেক্ষায় পড়ে রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ২১৫ কোটি টাকা।