শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ❙ ৮ আশ্বিন ১৪৩০

সুন্দরবনের কেওড়া ফল উপকূলীয় জনস্বাস্থ্যের জন্য হিতকর

স্টাফ রিপোর্টার: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. শেখ জুলফিকার হোসেন সুন্দরবনের কেওড়া ফল নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণালব্ধ ফলাফলে জানা যায় এই ফল উপকূলীয় মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। উপকূল অধিবাসী ছাড়াও সহজলভ্য এ ফলটি যে কোনো মানুষের স্বাস্থ্যের কয়েকটি দিকে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম। তাঁর গবেষণার ফলাফল দেশি-বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণাকর্মের ভূমিকায় তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এসকল ঝুঁকির অন্যতম হল সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উত্তরাঞ্চল থেকে নদ-নদী সমূহে মিঠা পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়া। এর ফলে, বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও নদ-নদীতে সমুদ্রের পানি ঢুকে লবণাক্ততা এক চরম সমস্যা রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এ অঞ্চলের ১০ লক্ষ হেক্টরেরও অধিক জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত। এ সমস্যার সমাধান অথবা এর সাথে খাপ-খাওয়ানোর উপায়সমূহ খুঁজে বের করে কাজে লাগানো আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের জন্যে আবশ্যক।
কেওড়া গাছ সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণে জন্মে। তাছাড়া, উপকূলীয় এলাকায় নতুন সৃষ্ট চরে এ ম্যানগ্রোভ গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে। লবণাক্ততা সহিষ্ণু এ গাছে প্রচুর ফল হয় যা কেওড়া ফল নামে পরিচিত। সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জেলাসমূহের লোকজন কেওড়া ফলের সাথে ছোট চিংড়ি মাছ ও মসুরীর ডাল রান্না করে খেয়ে থাকে। তাছাড়া, কেওড়া ফল হতে আচার ও চাটনী তৈরী করা হয়। এ ফল পেটের অসুখের চিকিৎসায় বিশেষতঃ বদহজমে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, সুন্দরবনে উৎপন্ন মধুর একটা বড় অংশ আসে কেওড়া ফুল হতে। তাই এ গাছটি হয়ে উঠতে পারে লবণাক্ততায় আক্রান্ত কর্দমাক্ত জমির বিশেষ ফসল। এ গাছ উপকূলীয় মাটির ক্ষয় রোধ করে মাটিকে দিবে দৃঢ়তা ও উর্বরতা, রক্ষা এবং লবণাক্ত পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সেল কর্তৃক প্রদত্ত গবেষণা অনুদানের অর্থে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ডঃ শেখ জুলফিকার হোসেন-এর গবেষণালব্ধ প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায় যে, কেওড়া ফলে রয়েছে প্রায় ১২% শর্করা, ৪% আমিষ, ১.৫% ফ্যাট, প্রচুর ভিটামিন বিশেষতঃ ভিটামিন সি এবং এর ডেরিভেটিভ সমূহ। কেওড়া ফল পলিফেনল, ফ্লাভানয়েড, এ্যান্থোসায়ানিন, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ও আনস্যাচুরেটেড ওমেগা ফ্যাটি এসিড বিশেষ করে লিনোলেয়িক এসিডে পরিপূর্ণ। তাই মনে করা হয়, ফলটি শরীর ও মনকে সতেজ রাখার সাথে সাথে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী। চা-এর মত এ ফলটিতে ক্যাটেকিনসহ বিভিন্ন ধরণের পলিফেনল প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। এদেশে প্রাপ্ত ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলিফেনল রয়েছে আমলকীতে তারপরই হল কেওড়া ফলের অবস্থান। কেওড়া ফলে সমপরিমাণ আপেল ও কমলা ফলের তুলনায় অনেক বেশি পলিফেনল ও পুষ্টি উপাদান রয়েছে। পলিফেনল শরীরে ডায়াবেটিক, ক্যান্সার, আথ্রাইটিস, হৃদরোগ, এলার্জি, চোখের ছানি, বিভিন্ন ধরণের প্রদাহসহ প্রভৃতি রোগ সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করে। ফলটিতে আমলকী, আপেল ও কমলা ফলের তুলনায় বেশি পরিমাণ পটাশিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম ও জিংক রয়েছে। এ ফলের রয়েছে ডায়রিয়া ও ডায়াবেটিক প্রতিরোধী এবং ব্যথা নাশক গুণাগুণ। ফলটি ডায়রিয়া, আমাশয় ও পেটের পীড়ার জন্যে দায়ী ব্যাক্টেরিয়াকে কার্যকরীভাবে দমন করতে পারে। তাছাড়া, কেওড়া ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ পালমিটিক এসিড, এ্যাস্করবাইল পালমিটেট ও স্টিয়ারিক এসিড যা খাদ্য শিল্পে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে এবং তৈরি খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। তাই উপকূলীয় এলাকার অনাবাদী লবণাক্ত জমিতে ফলটি ব্যাপকভাবে জন্মানোর উদ্যোগ নিলে প্রান্তিক জনগণের বাড়তি আয়ের উৎস হবে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে এবং উপকূলীয় পরিবেশের গুণগত মানের উন্নয়ন হবে বলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ডঃ শেখ জুলফিকার হোসেন মনে করেন। এ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রসমূহ অরিয়েন্টাল ফার্মাসী এন্ড এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিন ২০১৩, ইন্টারনেশনাল জার্নাল অব ফুড প্রোপার্টিজ ২০১৬ এবং প্রিভেনটিভ নিউট্রিশন এন্ড ফুড সায়েন্স ২০১৭ জার্নালসমূহে প্রকাশিত হয়েছে।

Related posts