শুক্রবার, ২৬ মে ২০২৩ ❙ ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহের কুঠিবাড়ি

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : বিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য ভাবনা ও অনন্য সাহিত্য কর্ম সৃষ্টিতে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ির রয়েছে বিশেষ অবদান ও পটভূমিকা। ঠাকুর পরিবারের জমিদারী পরিচালনার জন্য এখানে এসে তিনি ভালোবেসে ছিলেন ছায়াঘেরা নিভৃত পল্লী শিলাইদহকে।
এছাড়া আকৃষ্ট হয়েছিলেন এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য এবং প্রমত্তা পদ্মা নদী ও পদ্মার বুক থেকে বেরিয়ে আসা গড়াই নদীর প্রতি। ছায়াঘেরা নিভৃত পল্লীর এই কুঠিবাড়ি এবং পদ্মা ও গড়াই নদীর বুকে রচিত হয়েছে কবির সাহিত্য কর্মের শ্রেষ্ঠাংশ। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি কবির সাহিত্য কীর্তি ও নানা রচনার সঙ্গী। কবিগুরুর পদস্পর্শে শিলাইদহ গ্রামটি বিশেষ মর্যাদা ও পরিচিতি লাভ করে।
১৮৯১ সালে কবিগুরু জমিদারী পরিচালনার জন্য শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে আসেন। এই কুঠিবাড়ি থেকে তিনি পতিসর ও শাহজাদপুরের জমিদারী দেখাশুনা করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে পদ্মা নদীর তীরে মস্তবড় বড় নীলকুঠি তৈরি করা হয়েছিল। ওই সময় নীলের ব্যবসা ছেড়ে সাহেবরা চলে গেলে নীলকুঠির নীচতলা জমিদারীর কাচারি ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
পরবর্তীতে নদীর ভাঙ্গনে ওই নীলকুঠি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে ১৮৯২ সালে পদ্মার তীর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে শিলাইদহ গ্রামে ৩২ বিঘা জায়গা নিয়ে তিন তলার বর্তমান এই কুঠিবাড়িটি নির্মাণ করা হয়। ১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনার জন্য কবি শিলাইদহ গ্রামে থেকেছেন। পদ্মা-গড়াইয়ের মধ্যবর্তী স্থান ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারী এস্টেট। এই গ্রামের ছায়াঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করে পদ্মা-গড়াই নদীর বুকে কবি বিমুগ্ধ চিত্তে সাহিত্যের অনন্য সব রচনা করেছেন।
এখানকার মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কবি অগণিত প্রবন্ধ, কবিতা ও গল্প রচনা করে গেছেন। তার এসব লেখনীর মধ্যে সোনার তরী, মানসসুন্দরী, উর্বশী, চিত্রা, ক্ষণিকা, গীতাঞ্জলিসহ অনেক গান ও কবিতা নিভৃত এই পল্লীর পরিবেশেই রচিত হয়েছিল। ৩২ বিঘা জায়গা ঘিরে পৌনে চার বিঘা জমির উপর ঢেউ আকৃতির প্রচার বেষ্টিত শিলাইদহের কুঠিবাড়ি প্রতিষ্ঠিত।
তিনতলা এই কুঠিবাড়ির কামড়ার সংখ্যা ১৮টি। এর নীচতলায় ৯টি, দোতলায় ৭টি ও তিনতলায় দুটি কামড়া রয়েছে। প্রাচীন ঐতিহ্য ও জমিদারী নিদর্শনের অবয়বে গড়ে তোলা কুঠিবাড়ি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম। এই কুঠিবাড়ির পশ্চিমদিকে অবস্থিত পুকুরপাড়ের শান বাঁধানো বকুলতলার ঘাট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে ফুলের সুগন্ধ ও পাখির কলরবে কবি গান ও কবিতা লিখতেন।
কুঠিবাড়িতে কবির ব্যবহার্য জিনিষ-পত্র ও অন্যান্য সামগ্রী সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৮০টিরও অধিক বিভিন্ন দুর্লভ ছবি ও কবির ব্যবহৃত খাট, ইজি চেয়ার, লেখার টেবিল, স্পিড বোট, দুই বেহারার পালকি, ঘাস কাটা মেশিন, গদি চেয়ার, নৌকাসহ অন্যান্য ব্যবহার্য্য জিনিষ-পত্র রয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কুঠিবাড়ি সংরক্ষণ ও দেখাশুনার কাজ করছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এখানকার জমিদারীর হাত বদল হয়। জমিদারী প্রথা বাতিল হওয়ার পর কুঠিবাড়িসহ অন্যান্য সম্পত্তি সরকারের মালিকানায় আসে। উল্লেখ্য, শিলাইদহ থেকে জমিদারী ছেড়ে যাওয়ার পরও কবি বেশ কয়েকবার শিলাইদহে এসেছেন। তবে অন্তিম শয়নকালে কবির শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার স্মৃতি ধন্য ভালোবাসার গ্রাম শিলাইদহে আর আসা হয়নি।
কবির জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রতিদিন এই কুঠিবাড়িতে প্রাণের টানে ছুটে আসেন দেশী-বিদেশী পর্যটক। তবে এখানে পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তাসহ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এখনও গড়ে উঠেনি। পর্যটকদের বিশ্রাম ও থাকার জন্য সাদামাটা গোছের একটি ডাকবাংলো থাকলেও নিরাপত্তার অভাবে এখানে কেউ রাত কাটাতে সাহস করেন না।
প্রতি বছরের মত এবারও কবির ১৫৮তম জন্মজয়ন্তী পালন উপলক্ষে ২৫, ২৬ ও ২৭ বৈশাখ তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান উদযাপনের আয়োজন করা হয়েছে। তিন দিনের অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আলোচনা সভা, কবিতা আবৃতি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জেলার বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া কুঠিবাড়ি চত্বর ঘিরে বসেছে বাংলার চিরায়ত গ্রামীণ মেলা।

Related posts