বৃহস্পতিবার, ১ জুন ২০২৩ ❙ ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

এখন লড়াই বেঁচে থাকার

ডা. সারওয়ার আলী

একাত্তরে লড়াইটা ছিল একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য। সবাই সংঘবদ্ধ হয়ে, শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির লড়াই। সেদিন ঘর ছেড়ে লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। আজকের দিনে একটি অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে এমন একটি লড়াই, যেখানে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। এ কারণে একাত্তরের লড়াই আর আজকের লড়াইকে এক করে দেখার উপায় নেই। আসলে একাত্তরে বাঙালি জাতি লড়াই করেছিল বাঁচার জন্য। আর আজকের লড়াইটা বেঁচে থাকার জন্য। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখন বৈশ্বিক দুর্যোগ হিসেবে সামনে চলে এসেছে। যে জন্য এ বছর স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানটি অন্যান্য বছরের মতো আয়োজন করে করা যাচ্ছে না।

একাত্তরে আমরা কেন লড়েছিলাম? আসলে সংগ্রামটা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই শুরু হয়েছিল। কারণ তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালিদের ওপর শোষণ-নির্যাতন শুরু করে পাকিস্তানিরা। এমনকি মাতৃভাষার অধিকারও তারা কেড়ে নিতে চেয়েছে। আসলে তখনকার পূর্ববাংলাকে একটা ঔপনিবেশিক অঞ্চল হিসেবে শাসন করতে শুরু করেছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। এ কারণেই বাঙালিরা সেই ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। এ জন্য প্রথমে রাজপথেই আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলন দমন করতে পাকিস্তানিরা লাঠিচার্জ, গুলি- এমন দমন-পীড়ন নেই যে সেটা করেনি। কিন্তু বাঙালিকে দমানো যায়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর পাকিস্তানিদের ভয়ংকর হিংস্র রূপ বেরিয়ে এলো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তারা ঢাকায় গণহত্যা শুরু করল। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। বাঙালি এবার সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একদিকে সারাদেশে হত্যাযজ্ঞ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করতে থাকল পাকিস্তানিরা। আর একদিকে বাঙালির উদ্দীপ্ত বাঁচার লড়াই; বাঁচার জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য লড়াই।

নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেই স্বাধীন রাষ্ট্রটি পেয়েছে। যে রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র পাকিস্তানের চেয়ে ভিন্ন ছিল। কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ছিল ধর্মভিত্তিক। আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গঠিত হলো ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে। এখানে সব ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের স্বকীয় পরিচয় ও স্বাধীন সত্তা নিয়ে বাঁচার নিশ্চয়তা দেওয়া হলো ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের চার মূলনীতির মাধ্যমে। সেই চার মূলনীতি বাঙালির দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে উসারিত ছিল। সেই চার মূলনীতিই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের মূল ভিত্তি।

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর এসে দেখছি, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি খুব ভালোভাবে হয়েছে। ১৯৭২ সালে উন্নত বিশ্বের অনেকেই বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র হবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্র হবে। কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দারুণ এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে গত ১০-১১ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বিশ্বের বড় বড় দেশকেই বিস্মিত করেছে। কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে এই অগ্রগতিটা হয়নি। সমাজ এখনও পুরোনো ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারছে না। এর একটা বড় কারণ গত প্রায় দুই দশক ধরে বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ বেড়েছে। বৈষম্য বেড়েছে। এর প্রভাবটা বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে পড়ছে। আবার অর্থনৈতিক অগ্রগতি হলেও সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যও বেড়েছে এবং এই বৈষম্যের কারণেও মানুষের ভেতরে প্রতিক্রিয়াশীলতা জেঁকে বসছে।

এবারের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান অন্যান্য বছরের মতো আয়োজন করে করা যাচ্ছে না। তার কারণ আমরা সবাই জানি। একটি অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে বলতে গেলে মানব জাতিকেই লড়তে হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত দেশগুলোও আজ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেঁচে থাকার জন্য আজ মানুষকে একা হয়ে যেতে হচ্ছে। ‘সামাজিক দূরত্ব’ তৈরির জন্য আহ্বান জানাতে হচ্ছে। অথচ আমরা জানি, মানুষ বাঁচার জন্যই সমাজ তৈরি করেছে। সামাজিকতাই মানুষের রুচি, সংস্কৃৃতি, ঐতিহ্য, সভ্যতা গড়ে তুলেছে। আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে বহুদূর। বাংলাদেশ সমৃদ্ধির সোপানে আরও অনেক ওপরে উঠবে। কিন্তু তার জন্য এই বৈশ্বিক দুর্যোগে বেঁচে থাকতে হবে। বাঙালি বারবার লড়াই করে জিতে যাওয়া জাতি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আজকের বেঁচে থাকার লড়াইয়েও বাঙালি সাফল্যের সঙ্গেই জয়ী হবে।

ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

Related posts